বিজয়ী বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ
জাহিদ বিন মনির
বিশেষ সাক্ষাৎকার: বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দেশের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা সম্পর্কে আলোচনা ও সমালোচনা মূলক সাক্ষাৎকারে প্রতিক্ষণকে সময় দিয়েছিলেন স্যার ড. মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ। প্রখ্যাত এই বিজ্ঞানীর খ্যাতির ঝুড়িতে রয়েছে বহু সফল গবেষণালব্ধ ফল। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রথম সারির এই বিজ্ঞানী ইউডার প্রো ভিসি এবং ফ্যাকাল্টি অব লাইফ সাইন্স এর ডীন হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। প্রিয় পাঠক ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও বিজ্ঞানের সাম্রাজ্য বিজয়ী বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ স্যারের সাক্ষাৎকারে আপনাকে স্বাগতম।
: স্যার আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর, নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এই বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে যদি কিছু বলতেন।
:“মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো বিভীষিকাময় ছিল। তখন, মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে ১৯৭০ সালের ৩১ অক্টোবর আমার বাবা মারা যান। খুব মনে পড়ে যুদ্ধের সময় মাকে যখন বললাম, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে চাই। তখন মা বললেন, ‘তোমার ছোট ভাই বোন এবং আমাকে কে দেখবে?’
কারণ আমাদের বাসা ছিল মোহাম্মদপুরে, মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই বিহারীরা আমাদের বাসা দখল করে নেয়। ধরতে গেলে আমরা তখন রাস্তায়। সেই সময় আমারই এক বন্ধু ভারত থেকে ফিরে আসে। ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কি চিন্তা করছিস?’
আমি ওকে সব কথা বলার পর ও আমাকে বলল তোর না যাওয়াই ঠিক হবে আর তুই তো ঢাকায় বসেই আমাদেরকে সাহায্য করতে পারিস। তুই বায়োকেমিস্ট্রিতে পড়ছিস তুই আমাদেরকে অনেক ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবি। আমাদেরকে বিস্ফোরক দ্রব্য বানিয়ে দিবি।
এ ছিল এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসের সময়কার ঘটনা। তখনও সেভাবে যুদ্ধ শুরু হয়নি। বোমা ফাটানো আর মাঝেমাঝে গোলাগুলি হতো । সেসময় আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব থেকে রিএজেন্ট সরিয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য বানিয়ে দিতাম। আর আরেকটা কাজ আমাকে দেয়া হয়েছিল সেটা হচ্ছে পটাসিয়াম সায়ানাইড বানিয়ে দেয়া । পটাসিয়াম সায়ানাইড বানানোর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের খাবারের বা পানির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া। পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসে খাবারে সায়ানাইড মিশিয়ে দেয়া হতো। একবার প্রায়ই ধরা পরতে পরতে বেঁচে যাই আরকি । পাকিস্তান আর্মি বাসায় রেড করে। ওরা মূলত আলম ভাইকে ধরতে এসেছিল। যিনি আমাকে এই কাজে ঢুকিয়েছিলেন। আলম ভাই ছাদের একটা কুঠুরিতে থাকতেন। তো ওরা আলম ভাইকে ধরে নিয়ে যায় আর যাবার সময় আমাকে বেয়নেট দিয়ে একটা খোচা দেয়। বুকের উপর দাগটা এখনো আছে।
এরপর অবশ্য আরেকবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়ছিল সেটা আমার জন্মস্থান খুলনা যাবার সময়। উদ্দেশ্য ছিল ওখানে গিয়ে কিছু সহায়তা যদি করতে পারি। তবে দুবারই মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যাই। ১৬ ডিসেম্বর বা কোন জাতীয় দিন আসলে আমার মনে পরে যায় ঐ দিনগুলোর কথা। পাকিস্তানি আর্মি আর আমাদের দেশের যারা ওদের সহায়তা করেছিল আমি তাদের ভুলতে পারবো না। সেজন্যই বলছিলাম বিভীষিকাময় দিন ছিল।”
:স্যার আপনি ১৬ ডিসেম্বর কিভাবে উদযাপন করেন?
:“আমি তাহলে ১৯৭১ সালে ফিরে যাই। ১৬ ডিসেম্বর সকালে, খুব ভোরে আমি আর আমার বন্ধু আনোয়ার যে কিনা আমারই মতো মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্ফোরক বানিয়ে সহায়তা করতো । আমরা হেটে যাচ্ছি। কোথাও কোন পাকিস্তানি সৈন্য নেই । কি যে উৎসাহ উদ্দীপনা কাজ করছিল বলে বোঝাতে পারবো না। এখন তো আর তখনকার মতো তেমন শীত নেই। ঐ সময় আমি এবং আনোয়ার দুজনের গায়েই ছিল গেঞ্জি আর প্যান্ট অথচ আমাদের শীত করছেনা। তখন মনে হতো, হয়তো আমরাও কোন একদিন পাকিস্তান দখল করে ওদের একটা শিক্ষা দিতে পারবো্।”
:স্যার ৭১ এর ১৬ ডিসেম্ববর আর আজকের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে পার্থক্য কি? আপনার মতে এই পরিবর্তনটা কেমন, ভালো না মন্দ?
:“একটা ঘটনা দিয়ে বুঝিয়ে দেই। স্বাধীনতার পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর। আমদের ওখানে সবার বাড়ির সামনেই একটা করে ঠেলা গাড়ি। কারো বড়ি থেকে সোফা উঠছে, কারো বাড়ি থেকে টেবিল উঠছে কারো বাড়ি থেকে চেয়ার উঠছে। কারণ মন্ত্রণালয়ে কোন চেয়ার টেবিল নেই, তাই এগুলো সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে আমাদের মন্ত্রীসভার নতুন মন্ত্রীরা এসে সেখানে বসতে পারে। এমনকি বাজারের তরকারি ওয়ালাও দাম কম নিচ্ছে এবং বলছে স্যার বেশি করে নিয়ে যান । কারণ দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এই যে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা এর মধ্যে আমি ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি।”
:স্যার আপনার বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনের ঘটনাটা যদি বলতেন, এক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল বা কাদের অনুপ্রেরণায় আজকের এই সফলতা?
:“ বাবা মা একেবারে ছোটবেলা থেকে খুব উৎসাহ দিতেন। জোর না উৎসাহ দিতেন, বই পড়ো এবং নানা ধরনের বই কিনে দিতেন। সেই থেকে বই পড়া সখ ও অভ্যাস। তাছাড়া আমার খালু হলেন ড. কুদর-ই-খোদা। সেই সূত্রধরে মায়ের একটা কথা ছিল যে, ‘তোমার খালু হচ্ছেন পূর্ব পাকিস্তানের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। আমি দেখতে চাই তুমি একদিন তোমার খালুর মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়ে ওঠো।’ আর এই উৎসাহ বা অনুপ্রেরণা এটা মূলত পরিবার কাছ থেকেই পাওয়া।”
:আপনার শৈশবের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা কোনটি?
:“ছোটবেলার সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে যখন আমরা প্রি এসএস পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, আমাদের সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল ছিল খুব কড়া। আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট ছিলেন জাফর আহমেদ (পরে তিনি এএসসিতে ফাস্ট হন)। তো জাফর আহমেদকে স্কুলের হেডম্স্টার বললেন, ‘আশা করছি ফার্স্ট ডিভিশন পেতে পারো’।
সেকেন্ড ছিলেন- ইফতেখার রহমান। তাকে হেডমাস্টার বললেন, ‘ফার্স্ট ডিভিশন পাবে? দেখ কি হয়’!
থার্ড ছিলেন-কায়সার মাহমুদ হামিদুল হক। তাকে হেডমাস্টার বললেন, ‘ফার্স্ট ডিভিশন পাবে কিনা বলা যায় না।’
তারপরেই আমি। স্যার আমাকে বললেন, ‘তুমি ফার্স্ট ডিভিশন পেলে খুব আশ্চর্য হবো।’
আমাদের ক্লাসে ৩৫ জন ছাত্র ছিল। সবার শেষ রোল যার স্যার তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি পাশ করবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।’
অথচ আমরা ৩৫ জনই ভালো ভাবে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম। এসএসিতে আমি অল্পের জন্য সেরা বিশ জনের মধ্যে ঢুকতে পারিনি।
ঘটনা বলার অর্থ হলো স্কুল কতটা কড়া হলে, যে কিনা দেশের মধ্যে ফার্স্ট হলো তাকে বলা হচ্ছিল, ‘আশা করছি ফার্স্ট ডিভিশন পেতে পারো।”
:স্যার আপনি আমাদের আইডল আপনার আইডল কে ছিলেন?
:“আমি আইডল হিসেবে দেখতাম হর গোবিন্দ খোরানাকে।”
:বাংলাদেশের বিজ্ঞানের বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার তেমন কোন অগ্রতি নেই, স্যার আপনার মতে এর কারণ কি?
:“আমি দুটো কারণ উল্লেখ করব। প্রথমত, আমরা এখনো বিজ্ঞানকে বুঝতে পারিনি এটা হলো বাংলাদেশের মানুষের কথা। এই যেমন তুমি আল্লােহকে মানো না কারণ তুমি হাইব্রিড ধান উৎপাদন করছো। আর বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের সমস্যা হলো তারা মনে করেন সাহেবরা যা বলেছেন তার সবই সত্য । আর আমাদের সবই ভুল। আমি মনে করি বাংলাদেশি সকল বিজ্ঞানী যদি একসাথে দেশের জন্য কাজ করেন । তবে পাঁচ বছরের মধ্যেই বিপ্লব ঘটবে।
তবে এক্ষেত্রে আমি অভিযোগের সুরেই বলবো দেশের মিডিয়ার বিজ্ঞানের প্রতি উদাসীনতাও বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবনতির একটি কারণ।”
:স্যার সব সফল মানুষের পেছনেই আরো কিছু মুখ লুকিয়ে থাকে, আপনার সফলতার সহযোগী কারা?
:“বাসা থেকে শুরু করব নাকি ডিপার্টমেন্ট থেকে।
(স্যার আপনি যেখান থেকে চান)
এক্ষেত্রে আমার স্ত্রী প্রফেসর রওনক জাহান এবং মেয়ে রশনি নাহার সেই সাথে গবেষণায় আমার সহযোগী ঈশিতা মালেক, সাইয়েদা সিরাজ, ইরিনা ইসলাম, শফিউল আজম, ওয়াহেদ মোজাম্মেল হক এবং শাহনাজ রহমানের কথা উল্লেখ করব, মূলত এদের বাদ দিলে আমার মূল্য জিরো।”
প্রতিক্ষণ/এডি/জেবিএম